Studypress Blog
বাল্যকালের ১০টি ঘটনা যা মার্টিন লুথার কিং কে গড়ে তুলেছে
03 Nov 2020
ড.মার্টিন লুথার কিং নিজে যে আলোকিত দুনিয়া তৈরী করেছিলেন তিনি নিজে সেই দুনিয়াতে বাস করতে পারেন নি। তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার দুনিয়া ছেঁয়ে ছিল ঘৃণা, বৈষম্য এবং শোষণের দিয়ে। তার দুর্বিষহ জীবন শোষিত হয়েছিল জিম ক্রোয়ের আইন এবং বৈষম্যবাদের মহামারী দ্বারা।
আমরা সকলেই ড. কিংয়ের বক্তৃতা শুনেছি কিন্তু তার জীবন কাহিনী কখন জনগণের কাছ পর্যন্ত এসে পৌঁছায় নি।
১০. মানুষের তাদেরকে ঠকানোর মনোভাব তার দাদা মেনে নিয়েছিল
কিংয়ের বড় হয়ে এভাবে গঠিত হবার পেছনে তার বাবা, মার্টিন লুথার কিং সিনিয়রের অনেক অবদান রয়েছে। তার বাবার জীবন শুরু হয় একটি বাগানে, যেখানে কিংয়ের দাদা একজন মালি হিসেবে কাজ করতেন। তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো এবং কিং সিনিয়রকে তা মেনে নিতে বলা হয়েছিল।
এদিকে কিং সিনিয়র নিচু শ্রেণীর মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার ব্যাপারটা কখনো মেনে নিতে পারেন নি। তিনি ছোটবেলাতেই দেখেছিলেন কিভাবে তার বাবাকে তার বস টাকা না দিয়ে ঠোকাতেন। কিং সিনিয়র তা বলে বসলেন যা তার কোন সুফলে আসেনি। বস তখন তার বাবাকে বলেন যে 'যদি তুমি তোমার ছেলেকে (কিং সিনিয়র) সামলিয়ে রাখতে না পারো তবে আমি তাকে থাপ্পড় দিয়ে বসিয়ে দিবো।' তার বাবা চাকরি হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকেন এবং কিং সিনিয়রকেও চুপ থাকতে বলে বাসায় চলে যান।
একবার তার বাবা মাতাল অবস্থায় তার মাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতে নেন, তখন কিং সিনিয়র বাবার সাথে লড়াই করে তার মাকে বাঁচান এবং তখনই সেই খামার ছেড়ে এবং শহর ছেড়ে আটলান্টাতে পারি জমান।
তিনি তখন পণ করেন যে তিনি আর কখনো কারোর ক্ষেত চাষ করবেন না এবং তিনি তার ছেলেকেও একই শিক্ষায় দীক্ষিত করেন।
৯. কোন শেতাঙ্গ ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা
কিং জুনিয়রের যখন তিন বছর বয়স তখন থেকেই তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল একটি শেতাঙ্গ ছেলে, যার বাবার একটি দোকান ছিল ঠিক কিং জুনিয়রের বাসার বিপরীতে।
তারা স্কুলে ভর্তি হবার পর আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। তারা একই স্কুলে পড়তে পারে নি। কিংকে পড়তে হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুলে আর তার বন্ধুকে পড়তে হয়েছিল শেতাঙ্গদের স্কুলে। ছেলেটি আর তেমন দেখা করতে আসতো না। যখন তার বয়স ছয়, তখন সেই ছেলেটি এসে তাকে বলে যে তার বাবা তাদের একসাথে খেলাধুলা করতে দিতে চান না।
'এই প্রথম আমি স্বাজাতিকতা সম্পর্কে অবগত হলাম ' কিং পরে তা উপলব্ধি করে বলেছিলেন। তিনি এর আগে তাকে কখনো ভিন্ন ভাবেন নি সেই মুহূর্তের আগে। কিন্তু এখন তিনি বুঝতে পারলেন তাকে কোন চোখে দেখা হয়।
'সেই মুহূর্ত থেকে আমি সকল শেতাঙ্গ মানুষদের ঘৃণা করতে প্রজ্ঞা করি' কিং বলেছিলেন।
৮. তার বাবা তাকে খুব বাজে ভাবে মারতেন
কিংয়ের বন্ধুরা তাকে বলতো 'আমি তোমার বাবাকে দেখে যমের মত ভয় পাই '। এই কথার পেছনে কারণ ছিল। বাসায় এবং কাজে উভয় জায়গাতেই মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র ছিলেন একজন কঠোর মানুষ। তিনি একজন ধর্মযাজক ছিলেন, কিন্তু তিনি যীশুখৃষ্টের পন্থা অবলন্বন করতেন না। একবার তিনি ধর্মসভাতে একজনের মাথায় চেয়ার ভাঙার হুমকি দেন যদি না সেই লোক শান্ত হয়। আর এই ঘটনাটি তিনি খুব গর্ব করে বলে বেড়াতেন।
বাসায় অবস্থা আরও খারাপ ছিল। তিনি বেল্ট দিয়ে মার্টিন এবং তার ভাই আলফ্রেডকে বেহুস হবার আগে পর্যন্ত মারতেন।
৭. 'গন উইথ দ্য উইন্ড' এর প্রথম পর্দা উত্তোলনে কিং জুনিয়রকে দাসের পোশাক পোড়ানো হয়
১৯৩৯ সালে কিংয়ের বয়স যখন ১০ বছর বয়স, 'গন উইথ দ্য উইন্ড' এর আটলান্টা প্রিমিয়ারে তার অভিনয় করার সুযোগ চলে আসে। তার বাবাকে ৬০ জনের একটি গায়কদল গঠনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় শোটির জন্য, এবং তার ছেলের সেই গায়কদলের মধ্যে থাকার কথা। তাদের গ্যাবার কথা সম্পূর্ণ শেতাঙ্গ একটি দর্শকের সামনে, যারা ছিল জুনিয়র লীগের সদস্য আর যারা কেবল শেতাঙ্গ মানুষদেরই গ্রহণ করতো। তারা তাদের অভিনয় সঞ্চালনের আগে তাদের কে স্টেজে উঠানো হয় যেখানে পেছনে ছিল একটি খামারের ছবি আর তাদের জোড় করে পোড়ানো হয় দাসদের পোশাক।
৬. তার দাদি মারা যাবার পর তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন
কিংয়ের শিক্ষকগণ তাকে দেমাগী এবং গুটানো স্বভাবের ছেলে হিসেবে আখ্যা দিতেন, এবং তার পেছনে কারণও ছিল। কিংয়ের ১৩ বছর বয়স আস্তে না আসতেই তিনি দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
তার সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মহত্যার চেষ্টা এসেছিলো তার দাদি, জেনিস পার্কস এর মৃত্যুর পর। যেদিন তার দাদি মারা যায়, সেদিন তার দাদির সাথেই বাসায় থাকার কথা ছিল কিংয়ের, কিন্তু তিনি বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে যান। শহরে প্যারেড এসেছিলো, আর তা তিনি দেখতে ছুতে যান। যখন তিনি বাহিরে ছিলেন, তখন তার দাদি হার্ট এট্যাক করে মারা যান।
তিনি আত্মহত্যা করার জন্যে বাসার সর্বোচ্চ তলা থেকে লাফ দেন, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি , কিন্তু সুস্থ হতে লম্বা সময় লাগে তার। তার বাবা ঘটনাটি বলার সময় বলতেন যে, 'কিং এরপর প্রায় সারাদিনই কান্নাকাটি করত এবং রাতে ঘুমাতে পারত না' .
৫. তার বাবা জিম ক্রো এর আইন মেনে নিতে পারেন নি
কিং সিনিয়র ছিলেন একজন নাগরিক অধিকার সংস্থার কর্মী। তিনি আটলান্টাতে এন.এ.এ.সি.পি (NAACP ) এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন যিনি জিম ক্রো আইনের অনেকাংশই ধ্বংস করে দিতে একই সক্ষম হন। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কখনোই নিচু শ্রেণীর মানুষ হিসেবে নিজেকে মেনে নেন নি।
৪. তার প্রথম ভাষণের পর তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়
যদিও কিং জুনিয়র তখনো অনেক ছোট, তবুও তার মাঝে তার বাবার মতো এতো সাহস তার ছিল না।
৮ বছর বয়সে কিং একবার ভুলে এক মহিলার পায়ে পাড়া পরে। মহিলা সাথে সাথে তাকে চড় মেরে বসে এবং তাকে 'Nigger' বলে গালি দেয়। কিং তখন কিছুই করেনি। তার বয়স তখন আট আর মহিলাটি ছিল শেতাঙ্গ।
এছাড়াও কিংকে অনেক বাজে বাজে অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তার নিজের ভাষ্য মোতে তিনি সবচেয়ে বেশী রাগান্বিত হয়েছিলেন যখন তার বয়স ১৩ বছর বয়স। একটি প্রতিযোগীতার মারফতে তিনি একবার একটি ভাষণ দেন যার শিরোনাম ছিল 'The Negro and The Constitution', এরপর তিনি একটি বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে ১৪৫ কিলোমিটারের যাত্রা শুরু করেন বাসে।
যখন বাসে কিছু সাদা চামড়ার মানুষ এসে উঠে, তখন কিংকে তার আসন ছেড়ে দাঁড়ায় যেতে বলা হয়। কিং উঠতে না চাইলে বাস ড্রাইভার তাকে গালিগালাজ করতে থাকে। যার ফলে তিনি তার আসন ছেড়ে দেন এবং সমস্ত রাস্তা দাঁড়িয়ে আসেন আর শেতাঙ্গ যাত্রীগণ বসে বসে যাত্রা করেন।
৩. তিনি তার বাবার গীর্জার ব্যবপারে লজ্জিত ছিলেন
কৌশোর বয়সে পা দিতে না দিতেই কিং জুনিয়ার তার বাবার ধর্ম প্রচারের ধরণ দেখে লজ্জিত হন। তার বাবা একটি দক্ষিণাঞ্চলীয় ব্যাপ্টিস্ট গীর্জা চালাতেন, যা ভরপুর ছিল তালি আর চিৎকারে। যা কিংয়ের মতে শেতাঙ্গরা যে তাদের ব্যঙ্গ করত তাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছিল।
কিং গীর্জায় যেতেন কেননা তার সমস্ত পরিবার করেছিল দেখে। কিন্তু তার মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর অবিশ্বাস ছিল। তিনি নিজেই অবাক হয়েছিলেন যখন তিনি পাদ্রী হয়ে যান। তিনি পাদ্রী হয়েছিলেন কেননা তিনি বুঝেছিলেন এভাবেই তিনি মানুষের সামনে এসে বিভিন্ন সামাজিক ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন।
২. তিনি একজন শেতাঙ্গ নারীকে প্রায় বিয়ে করে ফেলেছিলেন
এক গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি তার কলেজের বেতনের জন্য কিছু বাড়তি কামাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি খামারে কাজ নেন। এখানে শেতাঙ্গদের পাশাপাশি কাজ করা হয় তার, আর এখন থেকেই তার শেতাঙ্গদের প্রতি যে ক্ষোভ আর ঘৃণা ছিল, তা দোমে যেতে থাকে। এখানে তিনি দেখতে পান যে, একজন নিগ্রোর মতই গরীব শ্বেতাঙ্গরা শোষণের শিকার হত।
তিনি এক শ্বেতাঙ্গ নারীকে প্রায় বিয়ে করে ফেলেছিলেন। মেয়েটি কাজ করতো কিংয়ের স্কুলের খাবারের ক্যান্টিনে। কিং মেয়েটিকে খুবই পছন্দ করতেন এবং তার বন্ধুবান্ধবদের বলে বেড়াতেন যে তিনি মেয়েটিকে বিয়ে করবেন।
তার বন্ধুগণ খুবই ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। তারা তাকে বলেছিলো যে এটি একটি বড় ভুল হবে, এবং শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় পক্ষই রেগে যাবে।
কিংয়ের পরিবার তাকে এই বিয়ে ভেঙে দিতে বাধ্য করে। তার এক বন্ধুর মতে কিং এই বেদনা থেকে কখনো বের হয়ে আসতে পারেন নি।
১. তিনি প্রথম সমতার সম্মুখীন হন ১৫ বছর বয়সে
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ২টি ক্লাস না পড়েই সামনের ক্লাসে উঠে যান। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে মোরহাউস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পাদ্রী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকেন। তার পরিবারে তার পড়শোনা চালিয়ে যাবার মত সামর্থ ছিল না। তাই তাকে কেনাটিকাটে একটি খামারে কাজ নিতে হয়।
এই খামারের সাথে মোরহাউস বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি ছিল যে তারা কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র কাজের জন্য পাঠাবে এবং খামার তাদের পড়াশোনার খরচ বহন করবে। কাজটি অনেক কঠিন ছিল, তাদের সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজই করতে হত এবং রাট ১০টায় কার্ফু জারি হত। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে এটি ছিল তাদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা।
কিং ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে ওয়াশিংটন পর্যন্ত নিজের আসন পছন্দ করে বসতে পারতেন। কিন্তু এরপর আটলান্টা পর্যন্ত যেতে তাকে কৃষ্ণাঙ্গদের কামড়ায় চলে যেতে হত। যার ফলে কিছু সময়ের জন্য হলেই তিনি সমতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারতেন।