Studypress Blog

প্রবন্ধ রচনাঃ বাংলাদেশ ও দারিদ্র্য বিমোচন

02 Jul 2021

দারিদ্র্য  এমন অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করার সক্ষমতা হারায়। সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসন, জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র্য সৃষ্টি করে।

১৯৮০-র দশকে দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য বাংলাদেশে একটি সহজ ও একমাত্রিক সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়। এ সংজ্ঞানুযায়ী দারিদ্র্য হচ্ছে খাদ্য গ্রহণের এমন একটি স্তর যা থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ কিলো-ক্যালরি পাওয়া যায় না। দারিদ্র্যপীড়িত জনসংখ্যার প্রাক্কলন কয়েকটি পদ্ধতিতে প্রস্ত্তত করা হয়। প্রথমত, ভোগ অভ্যাস এবং ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করে একটি খাদ্য তালিকা চিহ্নিত করা হয় যা নির্দিষ্ট পরিমাণ পুষ্টি তথা প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতিদিন ২,১১২ কিলো ক্যালরি এবং ৫৮ গ্রাম প্রোটিন সরবরাহ করতে পারে। পরবর্তীকালে উল্লিখিত খাদ্যতালিকার ব্যয় অপেক্ষা ১.২৫ গুণ কম মাথাপিছু আয়সম্পন্ন পরিবারগুলিকে মধ্যম শ্রেণির দরিদ্র এবং নির্ধারিত প্রারম্ভিক আয়ের চেয়ে ৮৫% কম মাথাপিছু আয়সম্পন্ন পরিবারগুলিকে চরম দরিদ্র পরিবার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সাধারণত পল্লী অঞ্চলের দারিদ্রে্যর আপতন এবং স্তর পরিমাপের জন্য উপরিউক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। পৌর এলাকার দারিদ্র্য পরিমাপের ক্ষেত্রে ক্যালরি গ্রহণের প্রারম্ভিক মাত্রা ছিল পল্লী এলাকার জন্য নির্ধারিত মাত্রা অপেক্ষা কিছুটা উচ্চতর। অবশ্য, বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং নীতিমালার কারণে জনপ্রতি কিলো ক্যালরির প্রারম্ভিক মাত্রা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে দারিদ্র্যাবস্থা প্রাক্কলনের জন্য ব্যবহূত তথ্য ও উপাত্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা-ব্যয় নির্ধারণ জরিপ থেকে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলের ৪৭.১% লোক দারিদ্র্যসীমা এবং ২৪.৬% লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অপরদিকে, শহরাঞ্চলের ৪৯.৭% দারিদ্র্যসীমা এবং ২৭.৩% চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্রে্যর আপতন ও স্তর পরিমাপের জন্য বিবিএস ১৯৯৫ সালে মৌলিক চাহিদার খরচ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। এ পদ্ধতিতে দরিদ্রকে দরিদ্র এবং অনপেক্ষ দরিদ্র-এ দুভাগে চিহ্নিত করা হয় এবং দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫.৬% অনপেক্ষ দরিদ্র ও ৫৩.১% দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। দারিদ্রে্যর বহুমাত্রিক পরিমাপের ক্ষেত্রে অনেকগুলি গুণগত বিষয় বা চলক তথা পুষ্টি, স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, নিরাপত্তা, বাসস্থান সুবিধা, পানীয় জল, শিক্ষা, আয়ু, সম্পদের অংশীদারিত্ব ও ভোগের অধিকার এবং সমস্যাবলির সাথে মানিয়ে চলা বা সমস্যা হ্রাস করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদি ও ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়। এসব চলক মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) সংযুক্তি করে ২০০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয় ১৩২তম। আর ২০০৭-০৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) অনুযায়ী মানুষের জীবন ধারণের গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে ১৪০তম। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০০৯ এর  রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ৪০% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে।

দারিদ্র্য আর বঞ্চনা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু, বিস্তৃতি আর ঐক্যবদ্ধতা এবং ৩০ লাখ শহীদের জীবন উত্সর্গে আমাদের মহান অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ৭৬ শতাংশ জনগণের দরিদ্রতা, খাদ্য ঘাটতি, চরম বেকারত্ব, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট (মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও তেল সংকট) এবং সর্বোপরি বিধ্বস্ত অবকাঠামো— এসব মিলিয়ে দুর্যোগপূর্ণ মহাক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা। সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগেই ‘বিপ্লব বিলাসী’দের শ্রেণীশত্রু খতমের সংগ্রামের কারণে দেশ-বিদেশে এক হতাশাজনক ও নেতিবাচক ভাবমূর্তির সম্মুখীন হয় জাতি। হেনরি কিসিঞ্জার ও তার ভাবানুসারীদের মন্তব্য, ‘বাংলাদেশ বাস্কেটকেস’ কিংবা তলাবিহীন ঝুড়ি, ওতে যা ফেলা হোক লাভ নেই। এমন প্রেক্ষাপটেই পাশ্চাত্যের দুই অর্থনীতিবিদ (জাস্ট ফালেন্ড ও জ্যাক পার্কিনসন) ‘বাংলাদেশ এ টেস্টকেস অব ডেভেলপমেন্ট’ মন্তব্য করেন। এই চ্যালেঞ্জপূর্ণ দেশই যদি উন্নয়ন ঘটাতে পারে, তবে কারো জন্যই আর উন্নয়ন অসম্ভব হবে না। সব হতাশাবাদীর কটাক্ষ আর ভ্রুকুটি মিথ্যে প্রমাণ করে সাড়ে চার দশক পরে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। প্রবৃদ্ধির হারকে আমরা উন্নীত করেছি বার্ষিক ৭ শতাংশের ওপর। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমানোর হারকে ‘অক্সফোর্ড রিসার্চ গ্রুপ’ আখ্যায়িত করেছে ‘বিস্ময়কর’ হিসেবে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ মন্তব্য করেছে, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে ১০টি উঠতি বাজারের একটি, যা হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রবৃদ্ধির দেশ। এ বছরটিতে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যাবে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে’ (১ জানুয়ারি, প্রথম আলো ২০১৬, প্রথম পৃষ্ঠা)। ক্যালিফোর্নিয়ার টাই গ্লোবালের সিইও পি কে আগরওয়াল মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলাদেশ নেক্সট ইকোনমিক জায়েন্ট’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে এবং তাদের একটি সরকার আছে, যার অর্জন এটি (আগস্ট ২, ২০১৫, বণিক বার্তা, পৃষ্ঠা-৪)। এমন উদ্ধৃতি অসংখ্য দেয়া যায়, সে কলেবর আর বাড়াচ্ছি না। শুধু বলা যায়, অপার সাফল্য নিয়ে এক গর্বিত বাংলাদেশ এখন সময় অতিক্রম করছে। সাফল্যের প্রধান সূচক হচ্ছে দারিদ্র্য কতটা কমাতে পারছি এবং এ সূচকে আমাদের সর্বশেষ অর্জনটাই আজকের আলোচনায় নিবদ্ধ রাখব। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস সম্প্রতি ‘ম্যাক্রো-ইকোনমিক আপডেট’ প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে— বাংলাদেশে বর্তমানে (২০১৬-১৭ অর্থবছর) চরম দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, তাও ভিত্তি বছর ২০১১-তে মাথাপিছু দৈনিক আয় মার্কিন ডলার ১ দশমিক ৯০ ধরে (ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে)। চরম দারিদ্র্যকেই বিশ্বব্যাংক বিশ্বব্যাপী পরিমাপ করে থাকে। এ দারিদ্র্যের পরিমাপ ভোগ-ব্যয়ের ভিত্তিতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বছরের জন্য আমরা প্রাক্কলন করেছি ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। মানে আমাদের প্রাক্কলন ও বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা দুই ধরনের দারিদ্র্যের হার পরিমাপ করে থাকি। মৃদু দারিদ্র্যের হার ও হতদরিদ্র বা চরম দারিদ্র্যের হার। সে-ই মৃদু দারিদ্র্যসীমার (moderate poverty) নিচে, যার মাথাপিছু মাসিক আয় ১ হাজার ৬০০ টাকার নিচে (২০১০ সালের ক্রয়মূল্যে) ও হতদরিদ্র সে, যার মাসিক আয় ১ হাজার ৩০০ টাকার নিচে (বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ১২৯৭ টাকা প্রতিজন মাসিক)। চলতি অর্থবছরে আমাদের উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং হতদরিদ্র বা চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০৫ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ, সেটা নেমে এসেছে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশে। গত এক দশকে কমেছে ৫৮ শতাংশ। প্রতি বছর ২০০৫ থেকে কমেছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে। এটাকেই বলে বিস্ময়কর সাফল্য। মাথা গুনতি দারিদ্র্য কমানোর সঙ্গে অপুষ্টি ও কম ওজনের সমস্যাও (যা ক্ষুধাজনিত কারণেই সৃষ্টি) নিরসন হতে হবে। মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অপুষ্টি ও কম ওজনের সমস্যাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ অপুষ্টিতে এবং শিশুদের ৩৩ শতাংশ এখনো কম ওজনের। এই কম ওজনের হার ১৯৯০ সালে ছিল ৬৬ শতাংশ। শিশুদের কম ওজনের হার ভারতে ৪৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৩২ ও শ্রীলংকায় ২৬ শতাংশ। তার মানে ক্ষুধার সমস্যাও আমরা দ্রুত কাটিয়ে উঠছি।

 

 

এখন আমরা দেখতে চাই, বাংলাদেশে বিস্ময়করভাবে দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি কী ছিল। প্রথমেই বলতে হয়, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, যা এসেছে বার্ষিক ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রবৃদ্ধি থেকে। আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে বিস্ময়করভাবেই। ২০০২-০৬ সময়ে মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ছিল ৪৪৭ মার্কিন ডলার, তা এক দশকে ৩ দশমিক ২৮ গুণ বেড়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলারে। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে দারিদ্র্য কমেছে দশমিক ৯৩ শতাংশ হারে। দ্রুত মাথাপিছু আয় বাড়াটাই এসেছে জাতীয় আয় বৃদ্ধি থেকে এবং এই জাতীয় আয় বৃদ্ধি দারিদ্র্য দ্রুত কমার ক্ষেত্রে ‘ম্যাজিক’ হিসেবে কাজ করেছে।

গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে সড়ক-জনপথের ব্যাপক বিস্তৃতি ও বৈদ্যুতিকায়ন (৮৬ শতাংশ পরিবার এখন বিদ্যুত্ সংযুক্তির আওতায়), পল্লী এলাকায় ব্যাপক অকৃষিজ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, যা দারিদ্র্য কমাতে ভূমিকা রেখেছে। কৃষিক্ষেত্রে বিশেষভাবে মত্স্য চাষ, পোলট্রি খামার, গবাদিপশুর খামার প্রতিষ্ঠা গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রসারিত হয়েছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং দারিদ্র্য নিরসনে প্রভূত সহায়ক হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় অকৃষিজ ব্যবসা ও ‘কৃষি ব্যবসা’ বিকাশে প্রবাসী আয় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ২০০২-০৬ সময়ে গড় প্রবাসী আয় এসেছে বছরে সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর ২০১১-১৫ সময়ে (ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে) গড় প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতির সঙ্গে সামাজিক খাতে ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি দারিদ্র্যের পরিমাণ ও ব্যাপকতা কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ২০০৮ সালে ১৩ শতাংশ দরিদ্র পরিবার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা ২০১৫ সালে ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এখন বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৩১ লাখ ৫০ হাজার, বিধবা ও দুস্থ নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা এ বছর ১১ লাখ ৫০ হাজার, ভিজিডি কর্মসূচির উপকারভোগী দুস্থ নারীর সংখ্যা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে এবার উন্নীত করা হয়েছে ১০ লাখে, মাতৃত্বকালীন ভাতা ৫ লাখে, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৭ লাখ ৫০ হাজার, যা এ বছর ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ রকম সুবিধাভোগীর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা, ল্যাকটেটিং মাদার, হিজড়া জনগোষ্ঠী, বেদে, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। সরকার ২০১৫ সালে সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এরই মধ্যে ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস ‘হাউজহোল্ড ডাটাবেস’ তৈরি করছে, যেখানে সব দরিদ্র পরিবারের তথ্য থাকবে, যাতে যাদের পাওয়া উচিত, তাদের বাইরে কেউ যেন সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর সুবিধা গ্রহণ করতে না পারে। এসব তথ্য উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সরকার সামাজিক খাতে প্রাধান্য দিয়ে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে এবং সেসঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি জোরদার করছে, যার মাধ্যমে দেশ ২০৩০ সালে কিংবা তার আগেই হতদরিদ্র শূন্যে নামিয়ে আনবে এবং দারিদ্র্যের ভয়াবহতা থাকবে না। এ বছর সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ ৪৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, যা বাজেটের সাড়ে ১২ শতাংশ। বহু এনজিও সরকারি দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে। দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর অবদান রয়েছে।

 

 

 

যদিও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার করতে সরকার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক সুরক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি (বর্তমানে ছোট-বড় ১৪২ কর্মসূচি ২২টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত) বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, তথাপি দারিদ্র্য থেকে পুরোপুরি মুক্তি একেবারে চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সংখ্যার দিক থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে এখনো ৩ কোটি ৭০ লাখ লোক, যা যেকোনো বিচারেই বিশাল। হতদরিদ্রের সংখ্যা এখনো ১ কোটি ৯৪ লাখ। বিশ্বে ১০৩টি দেশ আছে, যার লোকসংখ্যা ১ কোটির নিচে। দারিদ্র্যসীমার কিছুটা উপরে এমন ‘ঝুঁকিপূর্ণ বহু পরিবার’ আছে, যেগুলো ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, রোগশোকে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নিপতিত হয়। এই ওঠানামা পরিবারের সংখ্যাও দেড় কোটির উপরে। কাজেই চ্যালেঞ্জটা হেলাফেলার নয়, বরং যথেষ্ট ভাবনার বিষয় এত সাফল্যের পরও। জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমেছে, তবে কোথাও কোথাও আঞ্চলিক দারিদ্র্য এখনো প্রবল। যেমন— কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের হার ৬৩ শতাংশের ওপর (জাতীয় দারিদ্র্য হারের গড় ২৩.৫%)। হতদরিদ্রের সংখ্যা এখানে ৪৪ শতাংশ। পটুয়াখালী, খুলনা ও রাজশাহীতে এখনো উচ্চ দারিদ্র্যের হার বিদ্যমান। দেশে ১৫৮টি উপজেলা রয়েছে, যেখানে এখনো মৃদু দারিদ্র্য হার বাড়ছে। আর চরম দারিদ্র্য বাড়ছে এখনো ১৪৪টি উপজেলায়। সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুমিল্লা অঞ্চলের মেঘনা অববাহিকায় দারিদ্র্য বাড়ছে। জাতীয় গড় দিয়ে ভেতরের অনেক সত্য ঢাকা পড়ে থাকে, এও এমনই। আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আমরা সম-উন্নত, নিম্নআয় বৈষম্য নিয়ে একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে চাই। তা না হলে সামাজিক সংকটের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় এবং উন্নয়ন টেকসই হয় না। এ বাস্তবতায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আঞ্চলিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘অনুন্নত অঞ্চল বিশেষ তহবিল’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য যে অনুন্নত উপজেলা বা জেলাগুলোয় অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততা রয়েছে, বিদ্যুতায়নের পশ্চাত্পদতা রয়েছে, শিক্ষার হার কম, এ উপজেলাগুলোয় প্রবাসী শ্রমিক পাঠানো হয় খুবই কম। এ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, না হলে এসব অঞ্চলের দারিদ্র্য তো কমবেই না, বরং এখন যেমন বাড়ছে তেমন বাড়তেই থাকবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি গরিবদের শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায় সুযোগ সৃষ্টিতে। বিনামূল্যে বই দেয়া কর্মসূচি সরকারের অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। খাদ্য-পোশাকসহ শিক্ষার আরো ব্যয় রয়েছে, যা হতদরিদ্র পরিবার বহন করতে পারে না। তাই দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তি সর্বজনীন করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ভিত্তিতে আমাদের উন্নয়ন পর্যালোচনায় যেতে হবে। শুধু খাতভিত্তিক নয়, অঞ্চলভিত্তিক ‘বিশেষভাবে দারিদ্র্য হারের সূচকের ভিত্তিতে’ আমাদের বাজেট বরাদ্দের বিন্যাস হওয়া প্রয়োজন। দারিদ্র্যের সর্বশেষ বাস্তব চিত্র পেতে ২০১৫-১৬তে পরিচালিত ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপের’ ফল দ্রুত প্রকাশ হওয়া আবশ্যক। তাতে তথ্যনিষ্ঠ সর্বশেষ দারিদ্র্য পরিস্থিতি ও গতিধারা জানা যাবে।

বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। দারিদ্রে্যর মোকাবেলা করার জন্য দরকার যথাযথ পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও একাগ্রতা এবং সর্বোপরি দক্ষ ও সমন্বিত বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ ও কর্মপ্রেরণা। 

Govt Jobs

Bank Jobs

Viva Jobs