Studypress News

এনআরসি কী, এনআরসি নিয়ে এত উদ্বেগ ও আলোচনা কেন?

11 Sep 2019

এনআরসি (National Register of Citizens) শব্দে উত্তাল গোটা ভারত। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এনআরসি-র রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা জানিয়েছেন "৩ কোটি এগারো লাখ ২১ হাজার ৪ জন ভারতের নাগরিক পঞ্জীতে অন্তর্ভূক্ত হবেন, আর ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭জন ওই তালিকায় স্থান পান নি"।

আশঙ্কা, আসামে ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়বেন। কেন হঠাৎ এই পরিস্থিতি তৈরি হল আসামে , কেনই বা আচমকা খাড়া নেমে এল উত্তরপূর্বের এই রাজ্যে? আসাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গই বা কেন উদ্বিগ্ন?

এখন পরিস্থিতি

ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ সিটিজেন্স যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেই তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে যাঁরা স্থায়ী ভাবে অসমে বসবাস করছেন এবং ভারতীয় নাগরিক হিসাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, তাঁদের উনিশ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম নেই এই তালিকায়। তাই তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা করছেন।

তবে প্রশাসনের তরফে তাঁদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁরা আবেদন করলে জানিয়ে দেওয়া হবে কেন তাঁর নাম বাদ গেছে। নাম তোলার উপায়ও থাকছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।

নতুন তালিকা প্রকাশের আগে থেকেই অবশ্য অসমের সাতটি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শান্তি বজায় রাখতে আহ্বানও করা হয় আসামে বাসিন্দাদের।

কারা আসামে বাসিন্দা

১৯৫১ সালে জনগণনার ভিত্তিতে দেশে প্রথম ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ সিটিজেন্স তৈরি করা হয়। আসামের বাসিন্দা তাঁরাই যাঁদের নাম সেই তালিকায় ছিল অথবা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যাঁদের নাম আসামের  ভোটার তালিকায় ছিল। এখন যাঁরা আসামের বাসিন্দা, তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নিজে অথবা তাঁদের পূর্বপুরুষরা ওই সময়ে আসামের বাসিন্দা ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, যাঁরা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যাঁরা এ দেশে এসেছেন তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে বিদেশি নিগরিক হিসাবে।

যারা অবৈধ ভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছে, তারা মাত্র ছ-বছর এ’দেশে থাকলেই এ দেশের নাগরিক হয়ে যাবে, এই নিয়মে ঘোর আপত্তি আসামের। শুধু আসাম নয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্য রাজ্যগুলিতেও উদ্বাস্তু সমস্যা রয়েছে। ২০১৪ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচনের আগে এ দেশে আগত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে ফলও মেলে।

২০১৬ সালে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল এনে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বদল করার প্রস্তাব করা হয়। সেই আইনে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন ও পারসিক ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও ওই সব দেশ থেকে আগত কোনও মুসলমানকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ করা ছিল না।

নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এই বিলের প্রতিবাদ করে বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয় আসাম গণপরিষদ (অগপ)। প্রতিবাদ করে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু)। যদিও অসম অ্যাকর্ডের নেপথ্যে ছিল আসু।

আসাম অ্যাকর্ড

১৯৭৯ সাল থেকে আসামে আন্দোলন শুরু করে আসু। তাদের দাবি ছিল, আসামের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে, সে জন্য তারা আন্দোলন শুরু করে। শেষ পর্যন্ত   ১৯৮৫ সালের ১৫ অগস্ট একটি সমঝোতা সই হয় আসাম ও ভারত সরকারের মধ্যে। সই করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, আসামের মুখ্যসচিব এবং আসামের পক্ষে আসুর তৎকালীন সভাপতি প্রফুল্লকুমার মহন্ত, সাধারণ সম্পাদক বিকে ফুকন, উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। এর পরে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হন মহন্ত।

আসাম অ্যাকর্ড অনুযায়ী ১৯৫১ সালে জনগণনায় যাঁদের নাম আছে তাঁরা দেশের নাগরিক, তার পরে ১৯৬১ সালের জনগণনায় যাঁদের নাম যুক্ত হয়ছে তাঁরা ভারতে থাকলেও নাগরিক হবেন না, সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এমনকি বাংলাদেশ গঠনের সময় যাঁরা এসেছেন তাঁদের কথাও উল্লেখ করা হয়।

এনআরসি নিয়ে কংগ্রেস সরকার ঢিমেতালেই চলছিল, কিন্তু ২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে জানিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট সময়েই মধ্যেই এনআরসি নবীকরণ করতে হবে। তার জেরেই এই তালিকা প্রকাশ।

দেশের অন্য অংশে অবশ্য নিয়ম, যাঁরা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক।

আসাম অ্যাকর্ড ও সমস্যা

আসাম অ্যাকর্ড অনুযায়ী, যারা এ দেশের নাগরিক নয়, অর্থাৎ বিদেশি, তাদের বার করে দিতে হবে। কোথায় বার করে দেবে? এর আগে যখন এই পরিস্থিতি হয়েছিল, তখন তা বাঙালি খেদাও নামে পরিচিত হয়েছিল। ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক, বাংলাদেশিরাই বিভিন্ন সময়ে আসামে প্রবেশ করেছিল। তাই বিতাড়নের কোপ তাদের উপরেই পড়েছিল। বাংলাদেশীদের পাশাপাশি আসামের চিরকালীন বাসিন্দা বাঙালিদের উপরেও সেই কোপ পড়েছিল।


যাঁদের নাম এ দেশের নাগরিক তালিকায় নেই এবং একই সঙ্গে পাসপোর্টও নেই, তাঁদের কী হবে সেই প্রশ্নও রয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে, কিন্তু সেই আলোচনা নিষ্ফলা থেকে গেছে। সমস্যা বেড়েইছে।

তাই ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো এখনই হচ্ছে না। তা যদি না হয়, তা হলে তাদের পুনর্বাসন কী ভাবে হবে সেটাও চিন্তার। 

বেশি সমস্যা কাদের

যাঁদের স্কুল পাস করার প্ৰশংসাপত্র নেই, এতদিন মনে করছিলেন পঞ্চায়েতপ্রধানের প্ৰশংসাপত্র যথেষ্ট, এখন তাঁরাও সমস্যায় পড়েছেন। এঁদের বেশিরভাগই মহিলা। এই কারণে তৃণমূল কংগ্রেস এখন বলছে যে এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন মহিলারা।

কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধনী বিল অনুযায়ী সমস্যায় পড়বেন মূলত মুসলমানরা। কারণ বিলে স্পষ্ট ভাবে বেশ কয়েকটি ধর্মের কথা উল্লেখ করা থাকলেও, এখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কথা বলা নেই। তার কারণও সহজেই অনুমেয়, দেশ ভাগের সময়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা দেশ চাওয়া হয়েছিল, তাই ধর্মীয় কারণে মুসলিমরা দেশ ছাড়েননি, অন্য কোনও কারণে দেশ ছেড়ে থাকতে পারেন।

এখন কী

এনআরসি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে যাঁরা প্ৰশংসাপত্রর বাসিন্দা, এই আইন অনুযায়ী তাঁরা প্রমাণ দাখিল করতে পারলে ধর্মের ভিত্তিতে কোনও সমস্যা হবে না। তবে জানা নেই, যাঁদের এই তালিকায় নাম নেই, বাস্তবে কতদিন তাঁদের উদ্বাস্তু শিবিরের অসহনীয় পরিবেশে থাকতে হবে।

প্রকৃত সমস্যা হবে তাঁদের যাঁরা সত্যিই নাগরিক, আবহমান কাল ধরে বসবাস করছেন কিন্তু তার যথাযথ প্রমাণ দাখিল করতে পারছেন না। আর নাগরিকত্ব বিলের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত সমস্যা হতে পারে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরই।

এখন সমস্যায় পড়েছেন মহিলারাও। বিবাহের শংসাপত্র থাকলেও কোনও লাভ হচ্ছে না। তাঁর পূর্বপুরুষ যে এদেশেই থাকতেন, সেই প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। যাঁরা পঞ্চায়েতপ্রধানের প্রশংসাপত্র দিয়েছেন, তাঁদের কোনও সুবিধা হবে না।

মূল নিউজ: https://www.dailyo.in/bangla/politics/what-is-nrc-national-register-of-citizen-refugee-bengali-mamata-banerjee-assam-accord/story/1/25779.html