Studypress News

জলবায়ু পরিবর্তনের ২৯তম সম্মেলন এবং বর্তমান পরিস্থিতি

15 Nov 2024

আজারবাইজানে চলছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ২৯তম সম্মেলন, যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের উপর আলোচনা করা হচ্ছে। এই সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা কীভাবে আমাদের গ্রহের অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং সমাজে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে আলোচনা করছেন। এ উপলক্ষে আমাদের গ্রহ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বদলে যাচ্ছে, এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো।


১. কার্বন নির্গমন: কোথা থেকে এবং কারা বেশি করছে?


বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন দিন দিন বাড়ছে। প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং রাশিয়া শীর্ষে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু উন্নত দেশ তাদের কার্বন নির্গমন কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কার্বন নির্গমন স্থিতিশীল হয়েছে বা কমছে। কিন্তু এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশে এখনও কার্বন নির্গমনের হার বেড়েই চলেছে। এই অঞ্চলগুলোর অধিক জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের পরিসংখ্যানও গুরুত্বপূর্ণ। মাথাপিছু হিসাবে বিবেচনা করলে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ যেমন কাতার এবং সৌদি আরব উচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে পড়ে, কারণ তারা প্রচুর পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। এই দেশে গড়ে প্রতি ব্যক্তির কার্বন নির্গমন অনেক বেশি।


২. গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান উৎস


বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের সবচেয়ে বড় উৎস হলো বিদ্যুৎ খাত, যা মোট কার্বন নির্গমনের প্রায় ২৮ শতাংশ জন্য দায়ী। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকায়, এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যাপকভাবে কয়লা, তেল, এবং গ্যাসের ব্যবহার করা হয়, যা ব্যাপক পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটায়। শিল্প খাত, বিশেষ করে ভারী শিল্প যেমন ইস্পাত, সিমেন্ট এবং রাসায়নিক উৎপাদনে প্রায় ২২ শতাংশ কার্বন নির্গমন হয়। তৃতীয় বৃহত্তম উৎস পরিবহন খাত, যা ১৬ শতাংশ নির্গমনের জন্য দায়ী। কৃষি খাত থেকে আসে প্রায় ১২ শতাংশ নির্গমন, যা মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে। এই গ্যাসগুলো সাধারণত প্রাণিসম্পদ ও জমি ব্যবস্থাপনা থেকে নির্গত হয়।


৩. কার্বন নির্গমন বৃদ্ধির ইতিহাস


শিল্পায়নের শুরু থেকেই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন নির্গমন বেড়েছে৷ মানুষ উচ্চমাত্রার কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করায় পৃথিবী প্রাকৃতিক ‘কার্বন শোষক' যেমন বন এবং মহাসাগরে কার্বন জমা করেছে৷৪. পৃথিবী এখন পর্যন্ত কতটা উষ্ণ হয়েছে? বায়ুমণ্ডলে বাড়তে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর কণা আরো বেশি সূর্যালোকের উষ্ণতা আটকে রাখছে৷ এর ফলে বায়ুমণ্ডল একটি গ্রিনহাউসের মতো কাজ করছে, গ্রহের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে৷ ২০ শতকের তুলনায় - এবং বিশেষ করে গত পাঁচ বছরের মধ্যে - গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে৷ নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানে পর্যবেক্ষণ করা তাপমাত্রা এবং সেই একই স্থানের ঐতিহাসিক গড় তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য গণনা করে তাপমাত্রার পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়৷ বিভিন্ন স্থান থেকে তাপমাত্রা পরিবর্তনের এমন হিসাবের গড় করে বৈশ্বিক তাপমাত্রার পরিবর্তন নির্ণয় করা হয়৷ স্থানীয় পর্যায়ে বা আলাদা আলাদা মাসে তাপমাত্রার পার্থক্যও অনেক বেশি হতে পারে৷ উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রায় দুই ডিগ্রি উষ্ণ ছিল৷এই ধরনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রায় অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে এবং বিস্তৃত প্রভাব ফেলছে৷ তীব্র তাপদাহ, ফসলে বিপর্যয়, খরা, ঝড় এবং বন্যার মতো বিধ্বংসী চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ছে৷ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে হিমবাহ গলে যাওয়া এবং মহাসাগরে পানির মোট পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি৷


৪. বৈশ্বিক উষ্ণায়ন: পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি


২০ শতকের তুলনায় বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি সরাসরি কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনের সাথে সম্পর্কিত। অতিরিক্ত তাপ বায়ুমণ্ডলে আটকে থেকে গ্রহটিকে একটি বিশাল গ্রিনহাউসের মতো গরম করছে। ফলে আরও তীব্র তাপদাহ, খরা, এবং বন্যার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসটি ইতিহাসে উষ্ণতম ছিল, যেখানে তাপমাত্রা প্রায় দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।


৫. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি


বিগত ১৪০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এর প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি গত ২৫ বছরে ঘটেছে। এই বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ হলো হিমবাহ গলন এবং সমুদ্রের পানি তাপীয় প্রসারণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এই দ্বীপগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


কেন এই সমস্যা সমাধান জরুরি?


বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুভূত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চরম আবহাওয়ার ঘটনা যেমন হ্যারিকেন, দাবানল, খরা এবং বন্যার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে, কারণ শস্য উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব শুধুমাত্র পরিবেশের ওপরেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরেও প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে। গরমের ফলে কিছু অঞ্চলে শ্রম উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে এবং খাদ্য ও পানির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। গ্রহের পরিবর্তনগুলো দীর্ঘ মেয়াদে আরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।


এজন্য, বিশ্ব নেতাদের এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন স্তরের মানুষকে একত্রিত করতে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিটি দেশকেই ভূমিকা রাখতে হবে।