Studypress News
সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে বিডিবিএল ও রাকাব
04 Apr 2024
‣ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাকাবকে কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বিডিবিএলকে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ০৩-০৪-২৪ তারিখে ব্যাংক চারটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে আলাদা করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।
‣ সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংক চারটিকে জানানো হয়, শিগগির ব্যাংক একীভূত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা দেবে। এরপরই নীতিমালা মেনে নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
‣ সংশ্লিষ্ট চার ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, হঠাৎ গতকাল চার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে ডেকে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য আগে থেকে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি, এমনকি আলোচনার বিষয়বস্তুও বলা হয়নি। একটি সভায় সোনালী ব্যাংক ও বিডিবিএলের চেয়ারম্যান-এমডিকে জানানো হয়, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিডিবিএল ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। আরেকটি সভায় বিকেবি ও রাকাবকে একই ধরনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
‣ এর আগে গত ২৫ মার্চ বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। পদ্মা ব্যাংকের পর সরকারি খাতের দুই ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি দুর্বল দুই ব্যাংককে সরকারি মালিকানাধীন অপর দুটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেহেতু সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি ব্যাংককে একীভূত করা হবে, তাই রাকাব ও বিডিবিএল ব্যাংকের কর্মীদের চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
‣ জানা যায়, ১৯৭৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। আর ১৯৮৬ সালে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যাংকের শাখাগুলো নিয়ে গঠন করা হয় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এখন আবার দুটি ব্যাংককে এক করে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণ করা ৩১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপির হার ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা।
‣ এ ছাড়া গত ডিসেম্বর শেষে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
‣ অন্যদিকে ২০১০ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) একীভূত হয়ে বিডিবিএল ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু করে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৪২ শতাংশই ছিল খেলাপি। এ সময় পর্যন্ত বিডিবিএলের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৯৮২ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
‣ গতকালের সভায় সোনালী ও কৃষি ব্যাংককে জানানো হয়, যে দুটি ব্যাংককে একীভূত করা হবে, তাদের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণ কিনে নেবে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি। এরপর শুধু ভালো সম্পদ নিয়ে ব্যাংক দুটিকে একীভূত করা হবে। এতে চাপে পড়বে না ভালো ব্যাংকগুলো।
‣ বিকেবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বেশি সুদে আমানত নিয়ে কৃষকদের কম সুদে ঋণ দেওয়ায় কৃষি ব্যাংক ও রাকাবের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ। এখন যদি সরকার কৃষকদের কম সুদে ঋণ না দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাংক দুটি পরিচালনার উদ্যোগ নেবে কি না, সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে শুধু একীভূত করা হলে তাতে কিছু পরিচালন খরচ কমা ছাড়া আর খুব বেশি উন্নতি হবে না।
‣ ব্যাংক খাতের সংস্কারে নানা সমস্যার সমাধান করতে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি পথনকশা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে।
একীভূতকরণ কী?
‣ একীভূতকরণ বা ‘মার্জার’ হলো দুই বা ততোধিক কোম্পানির একত্রীকরণ। এর ফলে নতুন কোম্পানি সৃষ্টি হতে পারে; আবার আকারে ছোট কোনো কোম্পানি বড় কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হলে বড় কোম্পানির সঙ্গে ছোট কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে।
একীভূতকরণ দুই প্রকার হতে পারে। এক. ভার্টিক্যাল একীভূতকরণ। এ ক্ষেত্রে একই ব্যবসায় নিয়োজিত দুটি কোম্পানি একীভূত হয়। যেমন একটি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে সমজাতীয় একটি ব্যাংকের একীভূতকরণ। দুই. হরাইজনটাল একীভূতকরণ। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায় নিয়োজিত দুটি কোম্পানি একীভূত হয়। যেমন একটি ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির সঙ্গে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির একীভূতকরণ।
‣ আরও এক ধরনের একীভূতকরণ রয়েছে, যাকে বলা হয় অ্যামালগামেশন। ইংরেজি ‘মার্জার’ ও ‘অ্যামালগামেশন’ শব্দদ্বয়কে বাংলা করলে একই অর্থ দাঁড়ায়– একীভূতকরণ বা একত্রীকরণ। কিন্তু মার্জার ও অ্যামালগামেশনের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। অ্যামালগামেশন এমন একটি একত্রীকরণ পদ্ধতি, যেখানে দুটি সমমানের কোম্পানি এক হয়ে নতুন একটি কোম্পানির অস্তিত্ব সৃষ্টি করে।
‣ এ ক্ষেত্রে সৃষ্ট নতুন কোম্পানির শেয়ার অ্যামালগামেটেড কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তারা সবাই নতুন কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। দুই বা ততোধিক কোম্পানি যখন অ্যামালগামেশন পদ্ধতিতে একীভূত হয়, তখন তাদের সমুদয় সম্পদ ও দায় নতুন কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে স্থানান্তর করা হয়।
‣ উদাহরণস্বরূপ: ধরা যাক সমমানের দুটি কোম্পানি ক এবং খ। এই দুটি কোম্পানি অ্যামালগামেটেড হলে নতুন কোম্পানি কখ (ক+খ) হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে ‘মার্জার’ হলো এমন একটি একত্রীকরণ পদ্ধতি, যেখানে ছোট একটি কোম্পানি বড় কোম্পানির সঙ্গে একত্রিত হয়। এর ফলে নতুন একটি কোম্পানি সৃষ্টি হতে পারে; আবার বিদ্যমান কোম্পানি অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির আকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে যে কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানিকে এ পদ্ধতিতে একীভূত করে নেয়, তার আকারই বড় থাকে। আর সম্পদ ও দায় একীভূত কোম্পানির সঙ্গে একত্র (কনসলিডেট) করা হয়।
একীভূত কেন হয়?
‣ একীভূতকরণ একটি ব্যবসায়িক কৌশল। সঠিক ব্যবসায়িক কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ব্যবসায়িক কৌশল পরিকল্পনা অত্যাবশক। কারণ চিন্তা, পরিকল্পনা ও কার্যকরকরণ– এই তিনটি শিরোনামের অধীনে ব্যবসা পরিকল্পনায় উদ্যোক্তারা খুব কার্যকরভাবে লাভবান হন। দক্ষ নির্বাহী ও উদ্যোক্তারা সব সময়ই তাদের ব্যবসায় রেভিনিউ এবং মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৌশলগত বিকল্প খুঁজে বের করতে সচেষ্ট থাকেন। এই বিকল্প মূলত দুই ধরনের– অভ্যন্তরীণ (অর্গানিক) ও বাহ্যিক (ইনঅর্গানিক)।
‣ একীভূতকরণ এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক যুক্তি অনুসরণ করে ব্যবসা সম্প্রসারণ হলো বাহ্যিক বিকল্প। সুতরাং একীভূতকরণ সারাবিশ্বের করপোরেট জগতে অনুসৃত একটি ব্যবসায়িক কৌশল। কোনো নতুন ব্যবসা বা চলমান কোনো ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য নতুন করে সবকিছু শুরু থেকে নির্মাণ না করে চলমান অন্য কোনো সম্পূর্ণ বা আংশিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান একীভূত বা অধিগ্রহণ করে অল্প সময়ে কম খরচে ব্যবসা সম্প্রসারণ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে টার্গেট কোম্পানি এবং ক্রেতা বা একীভূত হওয়া কোম্পানি উভয় পক্ষই লাভবান হতে পারে। এতে মূলধন সংক্রান্ত খরচ হ্রাস পায়, প্রতিযোগিতার তীব্রতা কমে, মূল কর্মদক্ষতা (কোর কম্পিট্যান্স) বৃদ্ধি পায়, উৎপাদনের ক্ষেত্রে সিনারজিস্টিক বা বহুগুণ ফল পাওয়া যায়। সর্বোপরি দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও কর্মী গড়ে ওঠে।
এ পর্যন্ত কোন কোন ব্যাঙ্ক একীভূত করা করা হয়েছে?
‣ বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, এক ডজন ব্যাংককে একীভূত করার কাজ চলছে। এই ব্যাংকগুলোকে ডিসেম্বরের মধ্যে একীভূত হতেই হবে।
‣ যে সমস্ত ব্যাংক একীভূত হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে সেগুলো হলো: বেসিক ব্যাংক, বিডিবিএল, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
‣ এসমস্ত ব্যাংকগুলো দুর্বল এবং এদের ঋণের বোঝা বেশি থাকার কারণে এই ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা বা আত্মীকরণ করার প্রক্রিয়া চলছে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।