Studypress News

ভাড়াটে যোদ্ধা ভাগনার কারা, কোথা থেকে এলেন তাঁরা

24 Aug 2023

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে ভাগনার গ্রুপ। তাদের বলা হয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রয়োজন হলে এই বাহিনীকে ব্যবহার করে রাশিয়া। কিন্তু ২৪ জুন শনিবার খোদ পুতিনের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে বসেছে ভাগনার বাহিনী। এই বিদ্রোহের ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেছিল বিশ্ব। যদিও এই বিদ্রোহ থেমে গেছে। তারপরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইস্যু ভাগনার।

ভাগনার গ্রুপটি সম্পর্কে জানার আগে এই গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন সম্পর্কে জানা যেতে পারে।

প্রিগোশিনের জন্ম রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও জন্ম এই শহরেই। ১৯৭৯ সালে প্রিগোশিন প্রথম যখন অপরাধী সাব্যস্ত হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮। চুরির দায়ে আড়াই বছরের স্থগিত কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে যদি আবার একই অপরাধ করেন, তাহলে কারাভোগ করতে হবে। এর দুই বছর পরই চুরি ও ডাকাতির দায়ে তাঁকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেই সময় ৯ বছর কারাভোগ করতে হয় প্রিগোশিনকে।

কারাভোগ শেষে খাবারের ব্যবসা শুরু করেন প্রিগোশিন। এর কয়েক বছর পর নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে শুরু হয় অরাজকতা। এই সময়ে কৌশলে শহরে একটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ খোলেন তিনি। তখন থেকেই সেন্ট পিটার্সবার্গের বিত্তবান, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু হয় প্রিগোশিনের। পরে আরও কয়েকটি রেস্তোরাঁ খোলেন তিনি। এর মধ্যে একটি রেস্তোরাঁর নাম ছিল নিউ আইল্যান্ড। ভাসমান এ রেস্তোরাঁ নেভা নদীতে ভেসে বেড়াত। পুতিনের বেশ পছন্দের রেস্তোরাঁ ছিল এটি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও পুতিন তাঁর বিদেশি অতিথিদের নিয়ে এই ভাসমান রেস্তোরাঁয় যেতেন। এভাবে একসময় পুতিনের ঘনিষ্ঠ হন প্রিগোশিন। সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ হয় যে তিনি পেয়ে যান ক্রেমলিনের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব (একসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ছিল ক্রেমলিন। এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় সেখানে রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে পার্লামেন্ট ভবন ও সরকারের বেশ কিছু দপ্তরও)। যাহোক, ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহের মধ্য দিয়ে ‘পুতিনের পাচক’ পরিচিতি পান প্রিগোশিন। এরপর পেয়ে যান সামরিক বাহিনী ও সরকারি স্কুলে খাবার সরবরাহের দায়িত্ব।

ভাগনারের যাত্রাটা অবশ্য আরেকটু পরে। ২০১৪ সালে প্রিগোশিন প্রতিষ্ঠা করেন ভাগনার গ্রুপ। এটি হলো বেসরকারি সামরিক বাহিনী। যেকোনো দেশের সরকার চাইলে এই বাহিনীকে ভাড়া নিতে পারবে। ভাগনারই যে বিশ্বের প্রথম বেসরকারি সামরিক বাহিনী তা নয়, এমন বাহিনী আছে যুক্তরাষ্ট্রেও। এর একটির নাম ব্ল্যাকওয়াটার। এই বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ করেছে। ২০০৭ সালে এই বাহিনীর ওপর একটি বই লেখা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, ২০ হাজারের বেশি সেনা রয়েছে বাহিনীটির। আছে যুদ্ধবিমান, সাঁজোয়া যান।

আবারও ভাগনারের কথায় ফেরা যাক। ২০১৪ সালের কথা। সামরিক অভিযান চালিয়ে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিল, তখন আলোচনায় আসেন প্রিগোশিন। ওই অভিযানে ভাগনার যোদ্ধারা ছিলেন। যদিও ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি এটা অস্বীকার করে এসেছেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি স্বীকার করেন, তিনি স্বীকার করেন, ভাগনারের নিজস্ব যোদ্ধা আছে।

এরপর ২০২৩ সালে প্রিগোশিন স্বীকার করেন, তিনি ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি চালান। মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রভাবিত করেছিল এই প্রতিষ্ঠান। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছিল তারা। এসব কারণেই ট্রাম্পের জয় সহজ হয়েছিল।

এখানেই শেষ নয়। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার যে বাহিনী কাজ করছে, সেখানেও ভাগনার যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আফ্রিকায় পুতিনের বন্ধু নেতাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতেও কাজ করে তারা।

এবার আসলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, পুতিন কীভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছেন। ভাগনার বাহিনীর অনেকই রাশিয়ায় দোষী হিসেবে শাস্তির আওতায় আছেন। প্রিগোশিন এমন অনেককে তাঁর বাহিনীতে নিয়েছেন। আসলে এই বাহিনীতে যোগ দেওয়ার শর্তেই জেল থেকে ছড়া পেয়েছেন তাঁরা। এরপর ভাগনার বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করছেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে।

হঠাৎ ভাগনারের হলো কী

ভাগনার বাহিনীকে রাশিয়ার মূল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করতে চাইছে সরকার। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। কিছুদিন আগে উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী নিকোলাই প্যানকভ বলেছিলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীটিকে’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বলা হবে। এতে ক্ষুব্ধ ছিলেন প্রিগোশিন। আবার ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর তাঁর অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংকট দেখা দিয়েছিল। সেই সময়ও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সামরিক প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

এরই মধ্যে গত শুক্রবার প্রিগোশিন অভিযোগ করেন, সেদিন ইউক্রেনের ভাগনার যোদ্ধাদের ওপর রকেট হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগু। এতে ভাগনারের অনেক যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। যদিও এ অভিযোগ রাশিয়া অস্বীকার করেছে। তবে ক্ষিপ্ত ছিলেন প্রিগোশিন। এরপরই শনিবার তিনি বিদ্রোহের ঘোষণা দেন।

ব্যর্থ বিদ্রোহ

শনিবার বিদ্রোহ করে রাশিয়ার রোস্তভ-অন-দন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল ভাগনার বাহিনী। সেখানকার সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছিল তারা। তবে পুতিনের বন্ধু বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় এই সংকটের সমাধান হয়। ভাগনার বাহিনী ফিরে যায় তাদের নিজেদের জায়গায়। আর প্রিগোশিনের বেলারুশ যাওয়ার কথা। তবে তিনি এখন কোথায় রয়েছেন, তা জানা যাচ্ছে না। তাঁর ভাগ্যে আসলে কী ঘটবে, সেটাও বোঝা মুশকিল। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, তিনি পুতিনের ক্ষমা পাবেন না।

এ প্রসঙ্গে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের মস্কোর সাবেক ব্যুরোপ্রধান জিল ডগার্টি বলেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেন না। আবার পুতিন নিজেও বলেছেন, এই বিদ্রোহ পিঠে ছুরি মারার শামিল। ফলে প্রিগোশিনের ভাগ্যে কী আছে, এটা বলা মুশকিল।