Studypress News
কাতার সঙ্কট : মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি
04 Jul 2017
সৌদি আরব, বাহরাইন, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, লিবিয়া ও মালদ্বীপ কাতারের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার যে ঘোষণা দিয়েছে তা নজিরবিহীন, বিষ্ময়কর ও রহস্যময়। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পাশাপাশি, তারা কাতারের সঙ্গে বিমান, জল ও স্থলপথে সব যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। উপসাগরীয় এই রাষ্ট্রকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অজুহাত হিসেবে যদিও কাতারকে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার ব্যাপারে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, কিন্তু অভিযোগটি আসলে কতটুক সত্য তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মনে করা হচ্ছে, এ ধরনের সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো প্রভাবশালী দেশের হাত আছে। সত্য যা-ই হোক, এ ধরনের সিদ্ধান্তে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনৈক্যে আরো জলসিঞ্চন হবে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ময়দান আরো প্রশস্ত হবে। এতে আখেরে লাভবান হবে অস্ত্রবণিক যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত ইসরাইল। বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যদি কৌশলে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে ব্যর্থ হয়।
আরব অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এবং সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনের অভিযোগ তুলে সোমবার কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। পরে এ তালিকায় যুক্ত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইয়েমেন, মিসর, মালদ্বীপ ও লিবিয়া। কাতারের বিরুদ্ধে এ ধরনের সিদ্ধান্তের পেছনে ট্রাম্পের অস্ত্রবাণিজ্য, ইসরাইলের ষড়যন্ত্র এবং মিশর ও সৌদি আরবের ভিন্ন মতাবলম্বিদের সংবাদ আল জাজিরায় প্রচারসহ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। তবে, মোক্ষম কারণটি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতকে উস্কে দিয়ে ট্রাম্পের অস্ত্রবাণিজ্য বহুগুণ বৃদ্ধি করা। এই আরব বিচ্ছেদকে মধ্যপ্রাচ্যের ট্রাম্পিকরণ বলে সংঘাত ও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় উসকানির অভিযোগ তুলেছেন জার্মানসহ কয়েকটি দেশও।
তবে এর জন্য ক্ষতির মুখে পরতে পারে যুক্তরাষ্ট্রও। কারণ উপসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে কাতারেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং দোহা থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিই মুখ্যত ২০১৬ থেকে এই অঞ্চলে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’-এ বিমান হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধসজ্জার কেন্দ্রস্থল হয়ে আছে। এখানে প্রায় ১১ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। স্বভাবত, কাতার যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অবস্থানে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ এবং হতাশ।
কেবল সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়েই অন্যতম সহযোগী হিসেবেই নয় আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায়ও কাতার প্রধানতম এক মধ্যস্থকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। এইরূপ বিবেচনা থেকেই সর্বশেষ সৌদি পদক্ষেপের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দোহাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডানা সেল স্মিথ ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে’ রিয়াদ ও দোহার মাঝে দূরত্ব কমিয়ে আনার উপর জোর দিলেও ট্রাম্পের নতুন অবস্থান নিঃসন্দেহে সৌদি আরবসহ ছয়টি দেশের কাতারের সঙ্গে কূটনীতিক বিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ দেয়ার শামিল।
এর ফলে কাতারের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে স্থল ও জলপথে অবরোধধর্মী পরিস্থিতির আরো অবনতিই ঘটবে। এরইমধ্যে কাতারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভবিষ্যত সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিশ্বের প্রধানতম এক ধনী দেশ হলেও কাতারের স্থল সীমান্ত পুরোটাই সৌদি আরবের সঙ্গে এবং সেটা এখন কার্যত বন্ধ। পাশাপাশি সৌদি আরব তার আকাশ পথেও কাতারের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
বলাবাহুল্য, কেবল কূটনীতিক সম্পর্কছেদ বা অথনৈতিক অবরোধ আরোপেই সৌদিদের ক্ষোভ মিটছে না। বক্তৃতা বিবৃতিতেও হুমকি অব্যাহত রয়েছে। সৌদি শাসকদের অন্যতম ঘনিষ্ট এবং সৌদি-আমেরিকান পাবলিক রিলেশন অ্যাফেয়ার্স কমিটি’র প্রধান সালমান আনসারি সম্প্রতি এক বিবৃতিতে কাতারের আমিরকে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির পরিণতির কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
স্পষ্টত সৌদিরা যে কাতারের শাসন পরিমণ্ডলেও পরিবর্তন চাইছে এইসব বক্তব্যে তা স্পষ্ট। এছাড়া কাতারের সঙ্গে বিবাদের মাধ্যমে উপসাগর জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে সৌদিরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকেও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মনযোগ ভিন্ন দিকে সরাতে চাইছে।
সর্বশেষ পরিস্থিতিতে একমাত্র ভালো লক্ষণ হলো কুয়েত পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। লক্ষণীয়, ছয় জাতির উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে ওমান ও কুয়েত সৌদি-মিসর-দুবাই অক্ষশক্তির পদক্ষেপসমূহ অন্ধভাবে অনুসরণ করেনি।
তুরস্কও এই কূটনীতিক উত্তেজনায় সংলাপের গুরুত্বের কথা বলছে। তারা সৌদিদের সর্বোচ্চ কম খেপিয়ে কাতারের পক্ষাবলম্বন করবে বলেই অনুমান করা যায়। এর একটি বড় কারণ হলো কাতারে তাদেরও একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যা এরদোগান এই মুহূর্তে মোটেই সরাতে ইচ্ছুক নন। এছাড়া এরদোগান মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডেরও সমর্থক। যার প্রতি রয়েছে কাতারের শাসকদের সহানুভূতি।
আঞ্চলিক অপর পরাশক্তি ইরান এই ঘটনাবলীতে স্বভাবত নীরবে খুশী এবং প্রকাশ্যে কাতারের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা সৌদি স্থল অবরোধে খাদ্যসামগ্রীর সংকটের মুখে কাতারকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। ইরান থেকে এইরূপ সহায়তা মাত্র ১২ ঘন্টায় কাতারে পৌঁছতে সক্ষম বলে তারা জানিয়েছে।
যেহেতু মাত্র কিছুদিন আগে সৌদি আরব ও কাতারসহ গঠিত ‘আরব-ন্যাটো’ ছিল মূলত ইরানকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে। সে কারণে চলতি বিবাদে ইরানের জন্য বিশেষ স্বস্তির কারণ রয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও তার সমর্থক মিসর, আরব আমিরাত প্রমুখ কাতারের নাগরিকদের ১৪ দিনের মধ্যে এসব দেশ ত্যাগ এবং একইভাবে কাতার থেকে সৌদিদের ১৪ দিনের মধ্যে বের হওয়ার যে ঘোষণা দুই পক্ষ দিয়েছে তাতে ইরানবিরোধী এসব দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ব্যাপকভাবে দুর্বল হবে।
একইভাবে এই ঘটনায় স্বস্তির কারণ রয়েছে সিরিয়ার জন্যও। কারণ এতদিনকার সৌদি জোটে ভাঙ্গণ তাদের উপর কূটনীতিক ও সামরিক চাপ কিছুটা কমাবে।
বস্তুত ইরান ও সিরিয়া, বিশেষত প্রথমোক্ত দেশটি সৌদি-কাতার বিবাদে অন্যতম উপলক্ষ্য। গত ২৪ মে কাতারের সংবাদ মাধ্যমে এইমর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, কাতারের আমির শেখ তামিম ইরানবিরোধী সৌদি ভূমিকা সমর্থন করছেন না। এই সংবাদে সৌদি ক্ষমতাসীনরা ক্ষুব্ধ ছিল। যদিও কাতারের শাসক পরিবার বলছে এটি একটা ভুয়া সংবাদ ছিল। যা এক দল হ্যাকারের দুষ্ট আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবে কাতরকে নিয়ে সৌদি ক্ষোভের আরও কারণ ঘটেছে।
মাত্র কিছু দিন আগেই ইরানে হাসান রোহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় কাতার তাকে অভিনন্দিত করেছিল। এটাও সৌদি আরবের পছন্দ ছিল না। কিন্তু কাতারের জন্য ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, কাতার ও ইরানের মধ্যবর্তী সাগরের তলদেশেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র এবং তাতে উত্তোলন অধিকার রয়েছে উভয় দেশের। কিন্তু তার জন্য উভয়দেশের সম্পর্কের যেরূপ উন্নয়ন প্রয়োজন সৌদিদের তাতে আপত্তি আছে।
সৌদিদের আরেকটি অপছন্দের বিষয় ছিল বিশ্ব কূটনীতিতে কাতারের অগ্রসরমান ভাবমূর্তি। যেমন, আফগান সংকটে সমাধানে তালবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় কাতার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী। আবার প্যালেস্টাইন সংকটেও কাতারের বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা সৌদি আরবের জন্য বিব্রতকর। এমনকি ইয়েমেন যুদ্ধে কাতারের প্রায় এক হাজার সৈন্য সরাসরি সৌদি জোটে থাকলেও রিয়াদের শাসকদের প্রবল সন্দেহ দোহা ইয়েমেনে সৌদি বিরোধী হুইতি বিদ্রোহীদের গোপনে মদদ দিচ্ছে।
কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি-বাহরাইন-মিসর-দুবাই অক্ষশক্তির কূটনীতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ কাতার ছাড়াও খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে প্যালেস্টাইনীদের মাঝে, বিশেষত গাজায়। কারণ ২০১৪ সালে ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসপ্রায় গাজায় মূলত কাতারের অর্থেই হামাস পুনর্গঠন কার্যক্রম চালাচ্ছিলো। কাতার সেখানে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে বলে অঙ্গীকার করেছিল এবং ২০১৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত তার প্রায় এক পঞ্চমাংশ দিয়েও দিয়েছে।
কিন্তু সৌদি অবরোধে কাতার এখন গাজায় প্রদত্ত সহায়তায় কাটছাট করতে পারে। এছাড়া যেহেতু হামাসের সঙ্গে কাতারের এই নৈকট্যই সৌদি-কাতার মনোমালিন্যের অন্যতম কারণও সেকারণে যেকোন আপসরফায় এটাও থাকবে যে, কাতার এখন থেকে প্যালেস্টাইন প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে প্রকাশ্যে কম মদদ দেবে। স্বভাবত এইরূপ পদক্ষেপের অন্যতম সুবিধাভোগী হবে ইসরায়েল।
কাতারের সঙ্গে মিসরের ব্রাদারহুড দলের সম্পর্কও চলতি বিবাধের অন্যতম ইস্যু। যেকারণে ব্রাদারহুড বিরোধী মিসরের জেনারেল সিসি এই অবরোধে বিশেষভাবে শামিল। কাতারস্থ প্রচার মাধ্যম আল-জাজিরার ভূমিকায় জেনারেল আল-সিসি ক্ষুব্ধ। ‘আরব বসন্ত’-এ আল-জাজিরার বিশেষ উৎসাহমূলক ভূমিকা ছিল। এছাড়া বর্তমানে প্রায়ই মিসরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে এই সংবাদ মাধ্যমটি সিসি’র জন্য বিব্রতকর সংবাদ প্রচার করে। আল-জাজিরার উপর সৌদিদেরও বিস্তর ক্ষোভ।
বিশেষ করে ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে এবং সৌদি আরবের বাহরাইনে আগ্রাসন নিয়ে আল-জাজিরার কাভারেজ তাদের মাঝে বিস্তর উষ্মার জন্ম দিয়েছে। আল-জাজিরাসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরজুড়ে স্বাধীন মিডিয়ার উত্থানে কাতারের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এটা এক ‘ওপেন-সিক্রেট’ বিষয় যে, সৌদি যুবরাজ সালমান এবং আবুধাবির যুবরাজ জায়েদ মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে (২০১২-১৩ এ আরববসন্ত পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী) ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে জেনারেল সিসি ও দেশটির সামরিক বাহিনীকে বিশেষ সহায়তা দিয়েছিল।
ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের পর থেকে সালমান-জায়েদ-সিসি নেটওয়ার্ক কাতারের শাসক পরিবারকে বিশেষ লক্ষ্যবস্তু করেছে বলে আরব বিশ্বে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। কারণ ভবিষ্যতে অত্র অঞ্চলে আরব বসন্তের মতো কিছুতে উৎসাহ দেয়ার মতো শক্তি রাখতে অনিচ্ছুক উপরোক্ত ত্রিদেশীয় শক্তিজোট।
কাতারের বিরুদ্ধে সৌদিদের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হয়তো উপরোক্ত ত্রিদেশীয় লক্ষ্যেরই এক ধরনের অনুশীলন যাতে কাতারকে চাপে পেলে নতিস্বীকার করানোর নিরীক্ষা হচ্ছে। দীর্ঘদিন সৌদি আরব কাতারের নিকট থেকে বাহরাইনের মতো আনুগত্য আশা করেছিল। যা তারা পায়নি। বরং কাতারের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ক্রমে তাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়েছে এবং কাতারের শাসকদের আল-জাজিরার মতো গণমাধ্যমপ্রীতি মিসর, তিউনিসিয়া ও বাহরাইনে গণঅভ্যুত্থানকে সহায়তা দিয়েছে।
তবে মিসর-সৌদি আরব-দুবাই জোট তাদের চলতি কাতারবিরোধী পদক্ষেপের জন্য এমন এক মুহূর্তকে বেছে নিয়েছে যখন দেশটি ২০২২ এর বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের প্রস্তুতিমূলক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। স্বভাবত সৌদি অবরোধ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিমূলক নির্মাণ তৎপরতায় বিঘ্ন ঘটাবে এবং কাতার আপসমূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য হবে।