Studypress News
মুক্তিযোদ্ধা: সংজ্ঞা, নতুন তালিকা ও সুযোগ-সুবিধা
20 Dec 2016

নতুন মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় বেড়েছে পরিধি:
---------------------------------------------
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধার বয়স ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ন্যূনতম ১৩ বছর হতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণ করে গত ৬ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে এই বয়সের কথা বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। এর মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন; যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন; যেসব বাংলাদেশি বিশিষ্ট নাগরিক বিশ্বে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন; যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর যেসব সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত এমএনএ এবং এমপিএরা (গণপরিষদ সদস্য); পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত নারীরা (বীরাঙ্গনা); স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা এবং দেশ ও দেশের বাইরে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক দলের (মেডিকেল টিম) চিকিৎসক, নার্স ও সহকারীরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন।
নতুন করে আবার তালিকা:
------------------------------
১৯৭১ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে-- ছয়বার ।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে---- ১০ বার।
আসন্ন জানুয়ারি থেকে নতুন করে আরও মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করতে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখের বেশি হলেও অনলাইনে ও সরাসরি আরও দেড় লাখ আবেদন জমা পড়েছে। সাংসদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই কাজ চলছে।
তবে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অভিযোগ রয়েছে, এমন ৩০ হাজার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রণীত মুক্তিবার্তাকে (লাল বই) সঠিক ধরে নিয়ে মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করবে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর ধরে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হবে।
অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও লাল মুক্তিবার্তায় অনেকের নাম রয়েছে।
কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সই স্ক্যান করে সনদ জাল করেছেন।
কেউ কেউ জেনারেল এম এ জি ওসমানীর খোদাই করা (এমবোস) স্বাক্ষর জাল করেছেন।
এ ছাড়া জেলা-উপজেলা কমান্ডারের সই জাল করে বা যাচাই-বাছাই না করে সনদ দেওয়ার অনেক অভিযোগ এসেছে।
---এ জন্যই নতুন তালিকা করা জরুরি মনে করেন মন্ত্রী।
ছয়বার তালিকা প্রণয়ন:
----------------------------
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট সূত্র জানায়,
১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এর আওতায় ’৮৬-৮৭ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, যা জাতীয় তালিকা নামে পরিচিত; এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন।
১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল আমিন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম ইবিআরসিতে রাখা ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত তালিকা সংগ্রহ করে, যা ইবিআরসি বা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা বলে পরিচিত; এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তৎকালীন আহ্বায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ জ ম আমিনুল হক বীর উত্তম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচন পরিচালনার ভোটার সূচক তালিকা প্রণয়ন করেন, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৮৬ হাজার।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (সবুজ) হিসেবে পরিচিত, পরে আরও যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের আরেকটি তালিকা করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (লাল) হিসেবে পরিচিত।
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মমতাজ উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি করা হয়। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং এ থেকে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের তালিকার গেজেট প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে গেজেট আকারে প্রকাশিত তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, চারদলীয় জোট আমলে ৭০ হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপর তারাও জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা:
----------------------------------
মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা প্রথমে দুই বছর এবং পরে আরও এক বছর বাড়িয়ে দেয়। এরপরই নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর সন্তানদের জন্য বাড়ানো হয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনির জন্য নির্ধারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির পদ সংরক্ষণ করা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৮০টি আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি দুস্থ মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়া ও মেয়ের বিয়ের জন্য আবেদন সাপেক্ষে অনুদানও পান। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি হাসপাতালে সব রকম স্বাস্থ্যপরীক্ষা বিনা মূল্যে করাতে পারেন। ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড আছে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ও আসনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা সরকারের নির্দেশনায় বলা আছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ চাকরি কোটা রয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
Important News

Highlight of the week
