Studypress News
অলীক মানুষ: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
26 Oct 2016
উনিশ-বিশ শতকের পটভূমিতে এক মুসলিম পীরপরিবারের লৌকিক-অলৌকিক ওতপ্রোত জীবনের কাহিনী ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসের উপজীব্য। দীর্ঘ প্রায় একশো বছরের এই কাহিনী বস্তুত উপস্থাপিত হয়েছে কোলাজ রীতিতে। কখনও সিধে ন্যারেটিভ, কখনও মিথ ও কিংবদন্তী আবার কখনও ব্যক্তিগত ডায়রি, সংবাদপত্রের কাটিং মিলিয়ে মিশিয়ে দূর-ধূসর এক সময় এবং বিস্ময়কর মানুষের বৃত্তান্ত। কিন্তু সব মিলিয়ে আভাষিত হয়েছে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম জীবনের এযাবৎ অনাবিষ্কৃত একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক সনদ। মর্ত্যে নিয়ত অমর্ত্যের নিদর্শন-অন্বেষী এবং ক্রমশ শূন্যমার্গে ধাবমান এক ধর্মগুরু, অন্যদিকে তাঁরই ঔরসজাত এক সন্তান ঘটনা-পরম্পরায় ধর্মদ্রোহী হতে হতে নৈরাজ্যবাদী চেতনায় জর্জরিত-পরিণামে আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত সেই তরুণ নিষ্ঠুর ঘাতকে পরিণত হল, এই দুটি বিপরীত ব্যক্তিত্বের হঠকারী ও নানামুখী টানাপোড়েন শক্তিমান ঔপন্যাসিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ আশ্চর্য দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন। বাংলাসাহিত্যে এই উপন্যাস একেবারেই অনন্যসাধারণ-সব অর্থেই ট্রাডিশন বহির্ভূত। লৌকিক-অলৌকিক, প্রেম-অপ্রেম, মায়া-বাস্তবতার পরস্পর বিপরীত গতির মাঝখানে সংগ্রামরত মানুষ কী ভাবে অলীক মানুষে পরিণত হয় এবং কীভাবে সেই মানুষ মিথের বিষয় হয়ে ওঠে, এমন কুশলতায় আর কখনও বর্ণিত হয়নি। বহু অর্থেই এই উপন্যাস বঙ্গভূমির ইতিহাসের এক সন্ধিকালের প্রামাণ্য দলিল।
উপন্যাস জুড়ে আছে দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য জগতের দ্বন্দ্ব। মানুষ বদিউজ্জামান ও সাধক বদু পীরের দ্বন্দ্ব। বাস্তব-অলীকের সংঘাত, লৌকিক-অলৌকিকের মায়াবী আলো-অাঁধারি জগৎ, গতি এবং বিপ্রতীপ গতির দ্বন্দ্ব দেখা যায় এই উপন্যাসে। সুদীর্ঘ প্রায় একশ বছরের দেশসমাজের নানা পরিবর্তনের ইতিহাস দেখা যায় একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে। কখনো সলিটারি সেলে শফির আত্মকথন, কখনো বদিউজ্জামানের বয়ান। শফির ক্রমিক রূপান্তর। উপন্যাসের পর্বান্তরের মাঝে উনিশ-বিশ শতকের একটি পীর পরিবার, সামাজিক পট পরিবর্তন, মুসলমান সমাজ, ব্রাহ্মসমাজ ইত্যাদি সুন্দরভাবে চিত্রিত।
মায়া-বাস্তবতা মেশানো এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক সিরাজ বলেছেন : ‘অলীক মানুষ’ বলতে আমি বুঝিয়েছি ‘মিথিক্যাল ম্যান’। রক্তমাংসের মানুষকে কেন্দ্র করে যে মিথ গড়ে ওঠে - সেই মিথই (myth) একসময় মানুষের প্রকৃত বাস্তব সত্তাকে নিজের কাছে অস্পষ্ট এবং অর্থহীন করে তোলে। ব্যক্তিজীবনের এই ট্র্যাজেডি অলীক মানুষের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।... নিজের খুশিমতো নিজের আনন্দে লিখে গেছি। সেদিক থেকে দেখলে এই উপন্যাসের লেখক হিসাবে আমাকে অন্যতম নায়ক শফিউজ্জামানের মতোই স্বেচ্ছাচারী বলা যায়।’
সিরাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুইড উপন্যাসের সঙ্গে অলীক মানুষ উপন্যাসের কোথায় যেন একটা মিল আছে।’
পেশায় সাংবাদিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ' উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার - এসব ছাড়াও ভুয়ালকা পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত । তাঁর 'অমর্ত্য প্রেমকথা' বইয়ের জন্য জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার । এছাড়া ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার । পেয়েছেন বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার,সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতি পুরস্কার, দিল্লির OUF সংস্থার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি আরও অনেক পুরস্কার তিনি তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য-কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন । তাঁর অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে , যেমন 'কামনার সুখ দুঃখ' উপন্যাস অবলম্বনে 'শঙ্খবিষ" । দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় 'নিশিমৃগয়া' । উত্তমকুমার অভিনীত 'আনন্দমেলা' । অঞ্জন দাশ পরিচালনা করেছেন সিরাজের ছোটগল্প 'রানীরঘাটের বৃত্তান্ত' অবলম্বনে 'ফালতু' । সিরাজের "মানুষ ভূত" কাহিনী চলচ্চিত্র ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে ক্রমাগত অভিনীত হয়ে চলেছে ৷
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলায়। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
(অলীক মানুষ উপন্যাস ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে)