Studypress News
তুরস্কের সেনাঅভ্যুত্থানের চেষ্টাই সর্বপ্রথম না
26 Jul 2016
তুরস্কের এই ব্যর্থ সেনাঅভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় সেদিন (১৫ জুলাই ২০১৬ ইং) রাতে মারা যায় ২৯৪ জন। এরপরে ক্ষমতা শক্ত হাতে ধরার পর রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান কঠোর ব্যবস্থা নেবার উদ্দেশ্যে প্রায় ৬০০,০০০ এরও বেশি মানুষ গ্রেপ্তার করেছেন। তবে, তুরস্কের ব্যর্থ সেনাঅভ্যুত্থানই বিশ্বের প্রথম সেনাঅভ্যুত্থানের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল না।
সেই যীশু খ্রীষ্ট এর সময় থেকেই দেখা যায় যে, যাদের কোনো রাজকীয় রক্তের সম্পর্ক নেই বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো যোগসাজশ নেই তাদের জন্যে ক্ষমতা দখল করার একটি সাধারণ পন্থা ছিল সেনা অভ্যুত্থান। কোনো বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের থেকে এটির পার্থক্য হলো এখানে ঘটনাটি ঘটে খুবই আচমকা এবং এতে অংশগ্রহণ করে গুটি কয়েক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যাদের সেনাবাহিনীর সাহায্য হাতে থাকে। নেপোলিয়ন থেকে শুরু করে পিনোচেট পর্যন্ত ৫ জন নেতার কথা এখানে দেওয়া হয়েছে যারা সনাতন সেনাঅভ্যূত্থান দ্বারা ক্ষমতায় থাকা সরকারকে হটিয়ে দিয়ে আচমকা নিজেরা ক্ষমতায় চলে আসেন।
১.
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট:
১৭৯৯ সালের অক্টোবর মাসে বিখ্যাত মিশরীয় সেনা অভিযান থেকে ফেরার পরপরই নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফ্রান্সের তৎকালীন ৫ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা বোর্ডকে ক্ষমতাচুত্য করার নকশা আঁকতে থাকেন। কিছু উচ্চপদস্থ ষড়যন্ত্রকারী সহকর্মী, যাদের মধ্যে ছিল ৫ পরিচালকদের মধ্যে ২ জন, তাদের সাহায্যে নেপোলিয়ান একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন সম্বন্ধীয় আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেন যা ঘটিত হয়েছিল ১০ই নভেম্বর প্যারিসের বাহিরে। রটনা ছড়ানো, ঘুষ এবং জোর খাটিয়ে তিনি আসা করেছিলেন আইন প্রণয়নকারীগণ তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে। কিন্তু আইন প্রণয়নকারীদের ক্ষমতাসীন বড় দলটি তার দিকে কথার ক্ষিপ্রতা প্রদর্শন করে ও স্লোগান দিতে থাকে "একনায়ক নিপাত যাক" এবং তাকে সেই কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার জন্যে ধাওয়া করে। কিন্তু তিনি জয়লাভ করেন সেনাদের এলাকা ফাঁকা করাতে সম্মত করতে পেরে। এরপর তিনি সংবিধানকে অক্ষয় রাখতে নিজের হাতে একটি ছোট আইন প্রণয়নকারী দল গঠন করেন পরিচালকবর্গদের উচ্ছেদ করতে এবং নিজেকে একটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট রাষ্ট্রপ্রতিনিধি দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। প্রথম রাষ্ট্র প্রতিনিধি হবার সাথে সাথেই ১৮০৪ সালে নেপোলিয়ন তার ক্ষমতার একীভূতকরণ ঘটান, যখন তিনি নিজেকে সম্রাট হিসেবে অবিহিত করেন।
২.
ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো:
১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন একটি বামপন্থী সংগঠন স্পেনের নির্বাচন জিতে যায়, জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোকে তখন একটি সামান্য পদে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদিওবা তার সহকর্মী সেনা অফিসারেরা গোপনে একটি সেনাঅভ্যত্থানের নকশা আকছিলো, ফ্রাঙ্কো প্রথমে এতে যোগ দান করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। পরবর্তীতে এক রক্ষণশীল দলের নেত্রীর নেবার উদ্দেশ্যে খুন হবার পর তিনি মত পরিবর্তন করে এই ষড়যন্ত্রে যোগদান করেন। জুলাই এর ১৮ তারিখ ফ্রাঙ্কো একটি ইস্তাহার সম্প্রচার করেন যাতে তিনি সেনাবাহিনীর কাছে করজোড়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের পতন প্রার্থনা করেন। সমস্ত স্পেনের রক্ষীসেনাগণ তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, তিনি এরপর গোপনে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে স্পেনের নিয়ন্ত্রণাধীন মরক্কোতে আসেন, যেখানে বিদ্রোহ একদিন আগেই শুরু হয়েছিল এবং সেখানে যুদ্ধে পারদর্শী সেনাদের নেতৃত্ব দান করেন। তিনি ওদেরকে স্পেনের মূলভূমিতে ফেরির মাধ্যমে পারাপার করিয়ে নিয়ে আসেন এ ব্যপারে ফ্যাসিবাদী ইতালি এবং নাৎসি জার্মানি তাকে সাহায্য করে। সেনাঅভ্যূত্থান আংশিকভাবে সফল হয়, যেখানে ফ্রাঙ্কোর বিদ্রোহীসেনারা দেশের এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায় এবং একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে যা তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যদিও পরিশেষে তিনিই জয়লাভ করেন। ফ্যাসিবাদী, রাজতন্ত্রী, ব্রিটিশ জমি মালিকদের সমিতি এবং ক্যাথলিক পাদ্রীদের সমর্থনে "এল কৌদিললো" একনায়ক হিসাবে স্পেন শাসন করেন তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
৩.
মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি:
এক অশিক্ষিত বেদুইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি বড় হয়েছেন লিবিয়ার রাজতন্ত্রকে এবং এর পশ্চিমা সাহায্যকারীদের ঘৃণা করে। রাজতন্ত্রের দুর্বলতা তৈরি হলে তা উপলব্ধি করে ২৭ বছর বয়সী জুনিয়ার সেনা কর্মকর্তা ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর নিজে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নেন যখন রাজা ইদ্রিস নিজের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে দেশের বাহিরে ছিলেন। ত্রিপোলি এবং বেনগাজি শহরের মধ্যে দিয়ে সেনা যান চালিয়ে তিনি এবং তার সাথে আরো ৭০ জন ষড়যন্ত্রের সহকারীদের দিয়ে রাজ প্রাসাদ এবং অন্যান্য ভবনগুলো ঘেরাও দেন, সাথে সাথে সকল যোগাযোগের মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং কিছু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করেন। রাজার ব্যক্তিগত রক্ষীগণ খুবই নগন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, এবং দুই ঘন্টার মধ্যেই এই রক্তপাতবিহীন সেনাঅভ্যূত্থানের সমাপ্তি ঘটে। সেদিন সকালে রেডিওতে তিনি ঘোষণা দেন যে তার দল "দুর্নীতিগ্রস্থ" এবং "প্রতিক্রিয়াশীল" সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছে। প্রথমে কেউ বুঝতে পারছিলো না আসলে কে ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু গাদ্দাফি পরবর্তীতে লিবিয়ার সকল মানুষের উপর তার নিয়ম নীতি প্রণয়ন করতে সফল হন। ভিন্নমত প্রকাশকারীদের কঠোর হস্তে কণ্ঠরোধ করা এবং প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তিনি লিবিয়া শাহন করেছিলেন ৪২ বছর। ২০১১ সালে "আরব বসন্ত" বিদ্রোহে তাকে খুন করা হয়।
৪.
ঈদি আমিন:
একটি নম্র সূচনার পর ঈদি আমিন সেনাবাহিনীর সকল পদ পাড়ি দিয়ে উগান্ডার সর্বোচ্চ জেনারেল হয়েছিলেন। যদিও তিনি রাষ্ট্রপতি মিল্টন ওবোতের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন, যিনি ব্রিটিশদের হাত থেকে ১৯৬২ সালে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে দুই বন্ধু পরস্পরকে সন্দেহ করতে থাকে। সিঙ্গাপুরে এক সম্মেলনে যাবার ঠিক আগে দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভিত্তি ছাড়াই গোপনে আমিনকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। এই পরিকল্পনা আবার আমিনের কানে পৌঁছে যায়, যিনি ১৯৭১ সালের ২৫শে জানুয়ারি এই নির্দেশের জবাব দেন, যখন অবোতে দেশের বাহিরে ছিল। আমিন তার সৈন্যদের নিয়ে কাম্পালাতে চলে যান, সেখানে বন্দুক আর মর্টার ব্যবহার করে আমিনের দলবল খুবই অল্প সময়ে বিমানবন্দর এবং অন্যান্য কৌশলপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করে নেয় এবং তাদের সেনাঅভ্যূত্থানের সাফল্যের কথা রেডিওতে প্রকাশ করে। যদিও তিনি বলেছিলেন দেশে আনবেন, এই স্বঘোষিত "স্কটল্যান্ডের শেষ রাজা" শাসন করেছিলেন খুবই কঠোর হাতে, আর তার এই কঠোর ৮ বছরের শাসনকালে হত্যা করেছিলেন প্রায় ৩০০০০০ বিরোধীদলীয় নেতানেত্রীদের। উগান্ডার নির্বাসিত ব্যক্তিবর্গ এবং তানজানিয়ার সৈনিকদের দ্বারা পদচুত্য হবার পর তিনি কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত না হয়ে তার বাকি জীবন সৌদি আরবে কাটান।
৫.
অগাস্টো পিনোচেট:
অগাস্টো পিনোচেট চিলির সেনাবাহিনীর প্রধান ঘোষিত হন ঠিক যখন তিনি একটি সিআইএ দ্বারা তৈরি এক সেনাঅভ্যূত্থানে যোগদান করেন, যেটার প্রধান শত্রু ছিল সেই ব্যক্তি যিনি পিনোচেটকে পদন্নোতি দেন, যার নাম রাষ্ট্রপতি সালভাডোর আলেন্ডে। ১৯৭৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, চিলির নৌবাহিনী বন্দর নগরী ভালপারাইসো দখল করে নেন, আর ট্যাংকসহ সৈন্যবাহিনী ডাউনটাউন সান্টিয়াগোর রাষ্ট্রপতির প্যালেসের দিকে অগ্রসর হয়। এক উপনগরস্থ কমান্ড পোস্ট থেকে পিনোচেট দুইটি যুদ্ধ বিমানকে প্যালেসে রকেট নিক্ষেপের নির্দেশনা দেন। যখন আগুন প্রায় আকাশ ছোঁয়া, সৈন্যরা তখন ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে এবং আলেন্ডে , যিনি একজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত এবং মার্ক্সবাদী নেতা ছিলেন, তাকে আত্মসমর্পনের সুযোগ না দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। পিনোচেটের দলবল এরপরের বহুদিন খাটাখাটুনি করে আলেন্ডের সমর্থকদের খুঁজে বের করে এবং তাদের নির্যাতন করতে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচারের মাধ্যমে তাদের ফাঁসির ব্যবস্থা করে। এরপর পিনোচেট যে একনায়কতন্ত্রে শাসন শুরু করেন তা স্থায়ী হয় ১৭ বছর। পরবর্তীতে কংগ্রেস সম্পর্কিত সাক্ষ্য এবং কিছু গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার ফলে জানা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে সিআইএ বহু বছর ধরেই আলেন্ডের পতন রচনা করে যাচ্ছিলো, একাংশে আলেন্ডে বিরোধী ষড়যন্ত্রে আর্থিক সহায়তা করছিল এছাড়াও তারা নকশা আকছিলো উগান্ডার অর্থনীতিতে আঘাত হানার, যার সাথে সাথে সেনাঅভ্যূত্থান ঘটানোর মতো মানুষদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছিলো তারা। সিআইএ এছাড়াও এক গণতন্ত্রপন্থী জেনারেলের হত্যার সাথে জড়িত ছিল।